বিলাস এ বেনারস

১)
অহং উত্থানভূমি, রাত্রিকাল পেছনে ছাড়িয়ে যে বেদ পড়েছি এতকাল, তার দ্বারে টোকা দিতে আসি৷
— ক্যায়সা হ্যা ইয়ে বেনারস, হামারে শহর জ্যায়সা হি হোগা৷ ওহি লোগ, ওহি গঙ্গা যো কলকত্তা মে হ্যায়৷

মৃত্যুর খাটে বসে জীবন ফ্যাকাশে লাগে আর, ধোঁয়ার ওপাশে কিছু ধাঁধাঁ৷ এ জন্ম যৌতুক নিয়ে আসে, ঋণ থাকে আকাশে ফেরার৷ বোধ-ব্যাপ্তি-বিস্ময়ের প্রাপ্তি থেকে খুলে যায় নতুন দুয়ার৷

— জি কাঁহা চলেঙ্গে ভাইয়া জি, বি.এইচ.ইউ.. সারনাথ.. অসসি ঘাট..

জহন মে সন্দেহ্ ঔর দিল মে জিজ্ঞাসা আমাদের পথিক বানায়৷ একটি 'ই' এর তফাতে লালসাকে বিসর্জন করে দেওয়া যায়৷ পরিচিতি পেতে নয় পরিচিত হতে গেলে মুক্ত হতে হয়৷

এই স্বস্তিচায়ের দোকানে ব্যাবসা বুনতে এসে কোনো তাঁতিই মরে না৷ অথচ কী চমৎকার স্বাদ৷ 
— ভাইয়া অসসি ঘাট জানে কে লিয়ে টোটো ইয়াহা সে মিলতা হ্যা?
— জি 
— কিতনা লেতা হ্যা?
— শ রুপয় রিজর্ভ মে, আপ তিনজন হ্যা না... এ ভইয়া ইয়ে তিন জন কো অসসি ঘাট পহচা দো, কিতনা লোগে?
— দেড়শ
— সুবহ কা টাইম হ্যা, কিউ এয়সে বোলতে হো... শ মে লেকে যাও৷
— ঠিক হ্যা ভাইয়া জি আপ লোগ আইয়ে ইসমে৷

তফাত তুমিই করো ঘৃণা ও প্রেমের, স্বরের ভেতর ঘরে সহবত যতটুকু থাকে৷ টেনে আনো আমাকে আবার তোমাদের সুরভি উঠোনে৷

২)
দিকে দিকে মৃত ফুল, মজ্জার ভেতর পরজীবী; প্রয়াত মৃদঙ্গ তবু ঝংকারের আনন্দ ভোলেনি৷ জেম্বির চারমাত্রা গলিতে গলিতে বাশিটির অপেক্ষায়, বৈধব্যের যন্ত্রণা ভুলে শহরের এক কোণে সিঁটিয়ে রয়েছে৷ কেউ যদি নিয়ে যায় প্রেমিকের ঘাটে...

সুবহ্ কুছ এয়সি হি হো তমন্না থি জন্মো সে৷ তহে দিল সে স্বাগত হো, বে সবর্ হো আঁখে, এয় হ্ওয়া তুঝে না ছুঁতা তো এহসাস নেহি হোতা... ক্যায়সে খিঁচ লাতি হ্যা তু ইস দুনিয়া কো সদিয়ো সে৷
— ওয়াহহ.. কী অপূর্ব দৃশ্য, কত শান্তি বল
— হ্যা, কত ফরেনার রয়েছে দেখলি
— এমন ম্যাজিক্যাল মানসিক শান্তির বুকে কে না ঘুমোতে চায় বল
— গোপাল কিছু বল.. দেখ ও কিছু বলছে না, ফটো তুলে যাচ্ছে৷
— গোপালকে দড়ি বেঁধে রাখিসনে, ছেড়ে দে মা জননী৷ ওরে এবার চল লজ ঠিক করতে হবে৷ সামনা সামনি করবো৷

— তিওয়ারি গেস্ট হাউস, চল এখানে ঢোকা যাক৷

এভাবে আপন করে প্রত্যাশার ওপরে সম্মান, সম্বোধন, ব্যবহার! কথা তো ছিলনা৷ ফোঁকরে যেটুকু ছিল অবশিষ্ট বীজ, স্বরপুষ্পে মুগ্ধ করে আপন করেছে৷
— আপকে ইয়াহা রুম মিলেগা?
— জি বেটা, মিলেগা৷ তিনজন এক হি রুম পে রহোগে?
— হা
— শম্ভু, ইনকো রুম দিখা দো৷ কিতনে দিন কে লিয়ে আয়ে হো ঘুমনে? 
— তিন দিন
— আপ কাঁহা সে হো বেটা?
— পশ্চিম বঙ্গাল৷
— বহত অাচ্ছা, আপকো সব জগহ ক্যায়সে ঘুমনা হ্যা সব বতা দেঙ্গে৷ আপ পেহলে থোড়া ফ্রেশ হো জাও৷ বেটা বহত দূর সে আয়ে হো, নাস্তা কর লেনা৷ কুছ খরিদনা হো তো পেহলে মার্কেট পুরা ঘুম লেনা, দাম পুছ লেনা, ফির হিমালয়া কে স্টোর মে এক লড়কা হ্যা বান্টি নাম কা, উনকো বোলনা তিওয়ারি জি নে ভেজা হ্যা, উও আপকো সবসে বড়িয়া দুকান মে লে কর জায়গা৷

এমনই ফুলের কাছে বাঁধা পড়ে প্রজাপতিপ্রাণ৷ শখ করে পাগল হয়েছি, পা-হাত ছুঁড়েছি এক বিছানায়, মুক্ত হয়েছি বলে৷ মুক্তি, তবু মুক্ত নয়, এ যে মুক্তির বাঁধন৷

৩)
সূর্যস্নেহ যতদিন আসেনি এ ঘরে কুয়াশায় প্রকৃতি দেখেছি, যেন এক শূন্যতার মধ্যে খোলা চোখ অতীত ও ভবিষ্যত দেখেনা৷ ঘাটে ঘাটে যন্ত্রণার পেট ভোর হতে দু-হাত বাড়ায়৷ একফালি চুরি করা শ্মশানের জ্বলন্ত কাঠে সদ্যোজাত কুঁড়িগুলি কোল থেকে নাক মুছে ফুটে ওঠে রোজ৷

— এগারোটা বাজল, তাও কত কুয়াশা দেখেছিস!
— হ্যা, গুগল বলছে এখন দশ ডিগ্রি
— ওই দেখ কত পাখি! এত ঠাণ্ডাতেও জলে ডুব দিচ্ছে৷
— কল্লোল কে দেখ্ কী যেন খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যাচ্ছে৷ এত স্পিডে হাঁটছে কেন?
— কবির মন বৃন্দাবন খুঁজছে মনেহয়৷ হা হা হা...
— ও কী কোন রাধা দেখে ফেলেছে না কি এখানে?
— এ কবি, চল্ এখানে বসে ম্যাগি খাই৷ তারপর আবার হাঁটব৷

পেছনের ডাক শুনে হতভাগ্য নিশুতির কথা মনে পড়ে, যাকে কেউ প্রেমিকা ভাবেনি৷ ভয়ে পেয়ে দূরে সরে গেছে; অথচ আমার কোনো প্রেমিকাই নেই শতাব্দী প্রাচীন এই রাজবংশী ঘাটে৷ দুপাশের সিড়ি দিয়ে উঠে গেছে সুর কারাগারে বন্দী হবে বলে; যেন কোনো প্রেতাত্মার বিচ্ছেদের রাগ বাঁশির ভেতর থেকে আসে৷

— আচ্ছা অর্ডার দিই তাহলে তিন প্লেট৷ ভাইয়া নুডলস কিতনা করকে প্লেট দে রহে হ্যা?
— পয়ত্রিশ রুপয় প্লেট হ্যা ম্যান, হাউ মেনি?
— তিন প্লেট দিজিয়ে৷ ম্যা উয়াহা উপর সিড়ি মে ব্যায়ঠা হু৷ ওউর ইয়ে দো দোস্ত হ্যা৷
— ওক্কে ম্যান৷

—( যাহ কেলো করেছে! আমি তো হিন্দিই বললাম, আর একে তো দেখে মনে হল হিন্দি ভালই জানে তবে এমন হিংলিশ হাংলিশ টোন কেন!) অর্ডার করে দিয়েছি, আমি ওপরে বসে বাঁশি শুনছি, ম্যাগি রেডি হলে তোরা নিয়ে নিস৷

ইয়ে কোহর কি প্যাস, ইয়ে সুবহ কা এহসাস, দূর কহি সুরজ ভি তরস রহা হ্যা পাস আনে কো৷ কিরণে ভি পানি সে মাঙ্গ রহি ইজাজ্ত জ্যাসে এক সঙ্গম বাকি হ্যা পানি সে, অউর এক বুন্দ বিরাসত মে মিলি ইস বিরানে কো৷

পরিযায়ী পক্ষিসঙ্ঘ স্থিতধী জলের বুকে ডুব দিতে আসে৷ ঘন কুয়াশায় যেন মণিকর্ণিকার ঘাটে উড়ে যাওয়া আত্মার প্রেম চুপিচুপি শুদ্ধিস্নান সেরে নিতে পাখনা ভেজায়৷ ভাল করে আঁধার কাটেনি, প্রেমিক আত্মাটির অপূর্ণ চুম্বনের উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ইমনের রাগ ধরে বাঁশির ভেতর থেকে আসে৷ মুদিত পল্লবে সিড়িটির পদতলে আত্মহূতি দিতে বসে থাকি৷

৪)

আমাকে মৃতের সাথে আলাদা কোরো না, খোসার ভেতর জমা ছাই শুধু বয়ে চলে শরীরের ভার৷ মস্তিষ্কের বিসর্জনে মহাকাল থেকে মৃত্যুদূতটিকে আহ্বান করেছি৷ ভাঙেনি কোথাও, আমাকে নিজের ছায়া থেকে সে পৃথক করে আনে৷ কে যেন ছুঁড়ব বলে বিশ্বঢেলা দিয়েছে আমায়৷

হাটতে হাটতে মণিকর্ণিকার ঘাট, পোড়া গন্ধ অস্তিত্বের ছবি আঁকে ধোঁয়াকুণ্ডলীতে৷ সহস্র শতাব্দী ধরে এই ঘাটে আগুন নেভেনি৷ কাঠের মূল্যেই শেষ পৃথকীকরণ হয় ফুটপাথ ও রাজপ্রাসাদের৷

— গোপাল, এখান থেকে কী নিয়ে যাচ্ছিস বলতো?
— মানে? কী আবার নিয়ে যাব?

(আদর্শ অন্তর্নীহিত অর্থ ঠিক বুঝতে না পারলেও, কিছু একটা আছে তা আন্দাজ করে নেয়)
— আরে ও কবি, তোকে কবির ভাষায় প্রশ্ন করছে রে৷
— ওহহ.. (যতটা পারে চেষ্টা করে একটু চিন্তা করে পরিণত মননে বলল গোপাল) এই যে সবাই মারা গেলে ছাই হয়ে যায়, তবু এরা বেঁচে থাকতে কত হিংসা, লোভ, ধর্মিয় হানাহানিতে মেতে থাকে৷ মারা গেলে কী বা ধর্ম, কী বা ধন সম্পদ৷
— একদম ঠিক, এই যে ধারণার বীজ আজ জন্মেগেল বিপন্ন হৃদয়ে, এইটুকু ঘাট থেকে পাওয়া৷ স্বর্ণকণা, মোহরের চেয়ে বহু দামি এই নিষিক্ত বীজ৷
(নাকে রুমাল চাপা দিয়ে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছি তিনটি প্রাণী, উদ্দেশ্যহীনের মতো)

ঘাট ঘরে এগোতে এগোতে মাঝে মধ্যে ভেতরের শিশুটিকে জাগাচ্ছি সবাই৷ এক সিড়ি থেকে অন্য সিড়িতে লাফিয়ে চলা৷ ছেঁড়া কাপড়ে একটি উন্মাদ বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে আসছে৷ পাশেই নীলাভ সবুজ জল, কতটা গভীর তল কেউই জানি না৷

— আদর্শ, সরে আয় এদিকে৷
— কী হল বলতো?
— যেরকম ভাবে ওই পাগলটা আসছে, কোনো ভরসা নেই৷ বাইচান্স ঠেলে দিলে চাপ৷
— হ্যা, তুই তো সাঁতারও জানিস না, আমিও জানি না যদিও৷ আর একা কবি সাঁতার জানলেও কিছু করতে পারবে না৷ দেখবি শেষে তুই আমাকে ধরলি, আর আমি কবিকে৷ শেষকালে মাঝিগুলোই ছুটে এসে বাঁচাবে৷
(হালকা মজার ছলে বলে গেল গোপাল)
— চল এখানে বসে একটু সিগারেট খাওয়া যাক৷ পকেটে নিয়েই এসেছি৷ ঘাটে তো কোথাও বিক্রি হচ্ছে না৷
— হ্যা, গঙ্গার পাড়ে এমন চমৎকার হাওয়ায় সিগারেটটা খেতে দারুণ লাগবে৷ ম্যাগি খাবার পর আর খাওয়া হয়নি৷ চল এখানটায় বসি, বেশ পরিস্কার আছে৷

আমাদের পাশে আরও তিনজন বসে৷ বন্ধুত্বের সুরভি এমনই, ব্যক্তিত্বের সুঘ্রাণে বহু অচেনা পৃথিবী জড়ো হয় সুরভির আদান প্রদানে৷ কৃপণতা নেই;  যতটুকু অন্ধকার বাকি আছে তাতে শেষ আলোটুকু জ্বেলে নিতে পাশাপাশি বসা৷

ব্যায়ঠা হ্যায় দুনিয়া কভি কিসসা শুনানে.. মহব্বত, আঁশু ইয়া গমকি দাস্তান.. উড়ি হোগি জুলফেঁ ভি উসকি হাওয়াও কে ঝোঁকে সে.. জ্যায়সে হর দিল মে এক দুনিয়া হ্যা অউর লুটানে ওয়ালি কিমতি সামান৷

Comments

Popular posts from this blog

প্রথম কবিতা তোমার জন্য

তোমার সেই গোলাপী ঠোঁট

জ্যোৎস্না প্রেমের রাত