আমার কবিতা যাপন

উড়তে চাওয়া পাখি, তার ডানায় কুঠার
কখনো দুপুরে পোড়ে, অথবা নিজেরই ধারে ছাঁটা যায় ডানাখানি তার॥

বেশিরভাগ বাঙালী যেমন দু কলম লেখে নিজের জীবনে, সেভাবেই একদিন লেখা আসে আমারও কলমে। ব্যাচেলর জীবন, প্রেম , প্রেমে ব্যর্থতা, প্রথম চাকরি, সেখানেও টানাপোড়েন এই সবই যেন একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনের এক একটা প্রাকৃতিক অধ্যায়। ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে কাঁচা হাতে হয়তো কয়েকটা কবিতা লিখেছিলাম একসময়। সেই এক যুগ ছিল, ছোটদের শুকতারা আসতো বাড়িতে। সাধারণ ডাকে একদিন পোস্ট করে দিই, দেখি পরের মাসে সেই কবিতাই ছাপা হয়েছে ওই পত্রিকায়। সে এক শিশু মনের অনাবিল আনন্দ। তার পর আবার কবিতা লিখি বয়সসন্ধি কালে। যখন প্রথম প্রেম গন্ধ ছড়িয়েছে মনে ও মাথায়। এভাবেই হয়তো লেখা এসে গেছে এক একটা সময়ের অন্তর্জালে জীবনের ভাবনা জমাতে। অল্পবিস্তর লিখতে লিখতে ফেসবুক বেশ বড় ভূমিকা নেয় আর কিছু মানুষের ভালোলাগা প্রেরণা দেয় এই লেখার সমুদ্রে ডুব দিতে।

জীবনের রোদে ঘামতে ঘামতে মানুষ যখন অবকাশ পায়, নিজেকে নিংড়ে নিয়ে বের করে প্রকাশের ভাষা। কারো কাছে তা নিছক কবিতা, আবার কারো কাছে জীবনের এক অমূল্য পাণ্ডুলিপি। মনে আছে যেদিন প্রথম প্রেম হেঁটে যায় অন্য রাস্তায় সেদিন লিখেছিলাম "জ্বলছে ভালোবাসা" । আজকের দিনে দাড়িয়ে সে লেখা নিতান্তই শিশুর মতো লাগে, তবে সেই দিন থেকেই যে আমার কলম হামাগুড়ি দিতে শিখেছিল তা আজ বুঝতে পারি। এর পর বহু প্রেম , পাল্লা দিয়ে আরো কবিতা। প্রেমে পড়ার কিছু অলিখিত মানসিক শর্ত হয়তো সবারই থাকে, সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় সেই ধরন, সেই সঙ্গে লেখারও।

নিজের ঘরেই সূর্য নিজে পোড়ে আর অনেক দূরের কোনো পৃথিবীকে নিরন্তর আলো দিয়ে প্রতিনিয়ত সবুজ করে যায়৷ একই ভাবে মানুষও সব চেয়ে বেশি পোড়ে নিজের ঘরেই আর আমরা শুধু শুধু অন্যদের দোষারোপ করি। এভাবে পুড়তে পুড়তে কেউ রবীন্দ্রনাথ হয়ে যায়; কান্নার সাগরে ডুবে জীবনকে লিখতে গিয়ে মানুষের কম্পাস রূপে উঠে আসে জীবনানন্দ দাস।

কিছু লেখা অসমাপ্ত থাকে ; যেমন সংসারের কোনো ঘাটে অসমাপ্ত স্নান, কেউ ঠেলে ফেলবে সেই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। অসম্পূর্ণ প্রেম, ঘুণ ধরা বিবাহের পাতা, সেই পাতা ছিঁড়ে ফেলে নতুন পাতায় ফের শুরু, পরিবারে ব্রাত্য হওয়া, ঘর ছেড়ে ভাড়া বাড়ি, জীবিত ঈশ্বরকে নর্দমায় দেখা, ক্ষমা, ঘেন্না এ সবই যেমন আমার জীবনের এক একটি অধ্যায়... এই সব অধ্যায়ের ওপর নিজের ভাবনার কালি দিয়ে লেখার ধারাবাহিকতাই আমার কবিতা যাপন। যেন এক কবির প্রকৃত জীবন যাপন।
যখন জয় গোস্বামীর "আমরা সেই চারজন" পড়ি মনে হয় এই সেই কবিতা যা হয়তো আমি লিখতে চেয়েছি এতদিন। পরিবার, প্রিয় মানুষের মৃত্যু, ভাড়া ঘরে ওঠা, সেখানের দৈনন্দিন জীবন সব .. সব... আবার যখন পড়ি "পড়ন্ত বেলার রাঙা আলো" সেখানে বার্ধক্যের কোঠায় দাড়িয়ে অসম বয়সী প্রেমকে লেখা, তার প্রতিটি লাইন যেন  মাটি ফাটা রোদে ঝরে পড়া শ্রাবণের ধারা।
কত কবিতার পাতা ছিঁড়ে ফেলেছি দিকভ্রান্ত হবার আশঙ্কায়। পরের কবিতা যে খুব ভাল হয়েছে তা দাবি করার ধৃষ্টতা করি না। বহু নতুন কবিদের কবিতা পড়ি ফেসবুকে, তাদের থেকে ভালো লেখার জন্যে কখনোই নয়, বরং নিজে সমৃদ্ধ হবার জন্য। মাঝে মাঝে ডাক পেয়েছি কবি সম্মেলনে। আলোচনার চেয়ে বেশি মনে হয়েছে জাহির করার ভিড়ে ঢুকে পড়েছি। কবিতা শুনব বলে বেশ নামজাদা কবিদের ভিড়ে মিশে যেতে গেছি কখনো কখনো। সেখানে সারা সম্মেলন জুড়ে কোনো এক কবির যাপন, তার কবিতার নিজস্ব সাগর, তার জলে অর্ধস্নান সেরে বাড়ি ফিরেও এসেছি। কী অসাধারণ সব লেখা! লেখার ধরণের সাথে পরিচিত হয়েছি। তবে এটুকু বুঝেছি যে সে লেখা আমার জন্যে নয়। আমি নদীর জল খেতে পারি, সমুদ্রের জল খেতে গিয়ে বেশ কড়া লেগেছে বহুবার। তবে এই যাপনে এটুকু বুঝেছি যে আজকের মাটিতে দাড়িয়ে কিছু শর্ত মেনে কবিতা লিখতে হয় তবেই সে সব লেখা স্থান পায় নামজাদা পাতায়। আর যদি পকেটে ওজন থাকে তাহলেই সোনায় সোহাগা। টাকা দিয়ে কবির সম্মান কেনার জলে ডুবতে গিয়ে ফিরে এসেছি বাড়ি। এক আধটা মেমেন্টো যে পাইনি তা নয়, সে সব আমার নতুন স্ত্রী যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে। আর সাজিয়ে রেখেছে আমার বিক্রি না হওয়া দুই কাব্যগ্রন্থের দুটি গুচ্ছ। আমি শুধু চেয়ে দেখি আর ভাবি কতটুকু লিখতে পেরেছি... কেন?

আগে বাড়িতে আসতো বেশ কিছু পত্র পত্রিকা, নামজাদা না হলেও লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছি অনেক। তারা কেনো যে আমার কবিতা ছাপতো আজও বুঝিনি। রামায়ণ - মহাভারত যুগ থেকে এমন কোনো জায়গা দেখিনি যেখানে কূটনীতি নেই... বড় বড় পত্রিকা হোক বা লিটল ম্যাগ।

আজকাল কোথাও ছাপতে দিই না আর। ডায়রির পাতা, কখনো বা ফেসবুক এতেই আমার লেখারা বেশ আছে। আস্তে আস্তে যৌবন থেকে বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমার কবিতারাও আমার বয়সের সাথে সাথে। আমার যাপন থেকে এটুকু বুঝেছি, প্রতিটি মানুষই হল কবি অথবা কবিতা, যার কোনো জন্ম নেই , কোনো মৃত্যু নেই৷

Comments

Popular posts from this blog

প্রথম কবিতা তোমার জন্য

জ্যোৎস্না প্রেমের রাত

তোমার সেই গোলাপী ঠোঁট